জাতীয় আখ্যান-কাব্যের ধারায় মুসলমান কবি

Abstract
ইংরেজ আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে কাব্যধারা বাঙলা সাহিত্যে বিচিত্রভাবে প্রবাহিত হয়েছে তাকে নিয়েই আধুনিক বাঙলা কাব্যের ইতিহাস। এই ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায় জুড়ে আছে ক্লাসিক রীতিকে অনুসরণ করে রচিত আখ্যান কাব্য-সম্ভার। যার সূচনা হয়েছে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি কিন্তু জের চলেছে বিশ শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত, কখন সক্ষম সৃষ্টিতে সমৃদ্ধ, কখন অক্ষম প্রচেষ্টায় বিড়ম্বিত হয়ে। এ ধারা অনুধাবন করলে, এর ভালমন্দ বিচিত্র প্রয়াসের মধ্যে বিচরণ করলে, যে সাধারণ সত্যটি নজরে পড়ে সেটি হচ্ছে, এ কাব্যগুলো কবি-ধর্মের নয় বরং কবি-কর্মেরই নিদর্শন। কবির স্বতঃ-উৎসারিত আবেগের চেয়ে সচেতন প্রচেষ্টার স্বাক্ষর এ সবে বেশী ক'রে পাওয়া যায়। একটা আখ্যানকে অবলম্বন করে বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে কবি তাঁর কালের চিন্তা-ভাবনা, তাঁর সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সর্বোপরি তাঁর নবলব্ধ জীবনবোধকে রূপায়ণের ব্যাকুল প্রয়াস পেয়েছেন। আর সে প্রয়াসের সূচনা হয়েছে পাশ্চাত্য শিক্ষায়, জ্ঞানে এবং ভাব ধারায় সচকিত সাহিত্যিকদের দ্বারা। পাশ্চাত্য ক্লাসিক কাব্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা মহাকাব্য রচনার চেষ্টা করেন। এ কালে বাঙলা গছা ছিল অপুষ্ট। নব প্রাণ-চাঞ্চল্যে উজ্জীবিত কবিগণ তাঁদের ভাব-কল্পনাকে রূপায়িত করার চেষ্টা করেছেন মহাকাব্য বা আখ্যান কাব্যগুলোতে। মধ্যযুগের বিজয় ও মঙ্গল কাব্যগুলোর মধ্যে আমরা তদানীন্তন যুগচিন্তার ক্ষীণ প্রতিফলন দেখতে পাই। আধুনিক কালের মহাকাব্য রচনার প্রয়াসের মধ্যে যুগ-চেতনার প্রকাশ অধিকতর সুপরিস্ফুট। তুর্কি অভিযানের আঘাতে সাহিত্যে অভিজাত ব্রাহ্মণ শ্রেণীর একচেটিয়া প্রভাব ছিন্নভিন্ন হয়ে প্রাকৃতজনের ছড়া, পাঁচালী প্রভৃতি সাহিত্য গড়ে উঠেছিল মধ্যযুগে। আধুনিক যুগেও সাহিত্যের স্বরূপে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং তারই বিক্ষিপ্ত পরিচয় একালের আখ্যান কাব্যগুলোর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। ঊনিশ শতকের গোড়া থেকেই শিক্ষিত নাগরিক-চিত্তে যে আত্ম-সচেতনতা,আত্ম-প্রতায় এবং মর্যাদাবোধ জাগ্রত হ'তে দেখা যায় তা সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য ক্রমেই ব্যাকুল হয়ে উঠে আর এ ব্যাকুলতা থেকেই জন্ম নেয় জাতীয়তাবোধ। আত্মশক্তি সম্পর্কে সচেতনতাই সেদিনের মানুষকে প্রেরণা দিয়েছিল জাতীয় শক্তির মহিমাকে প্রত্যক্ষ করতে কিন্তু বর্তমানের শূন্যতা সম্পর্কেও তাঁরা ছিলেন সচেতন, কাজেই তাঁদের দৃষ্টি ফিরেছিল পুরাণ এবং ইতিহাসের দিকে। ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক কাহিনীর অন্তর্নিহিত সংঘর্ষ এবং কোলাহলকে রূপায়িত করার মধ্য দিয়ে নিজের জাতীয় চরিত্রে বীরত্ব, ত্যাগ, আত্মপ্রত্যয় প্রভৃতি মহৎ অনুপ্রেরণা তাঁরা দিতে চেয়েছেন। ছন্দ, উপমা, অলঙ্কার, শব্দ-সম্পদ প্রভৃতির সৃষ্টি ঐ আনুষঙ্গিক প্রয়োজন সিদ্ধির জন্যই হয়েছে। কবি মনের মহৎ ভাবকে রূপায়ণের জন্য তাঁরা কাব্যে ক্লাসিক রীতির সুসংহত বিন্যাস ও সুবিপুল গাম্ভীর্য সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। বাঙলা কাব্যের দুর্বলতা দূর করার সজ্ঞান চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ক্লাসিক কাব্যের উত্তুঙ্গ শিল্পাদর্শ, সুকঠিন সংযম এবং সুগভীর প্রজ্ঞা তাঁদের কাব্যে রূপলাভ করে নি। কোথাও ক্লাসিক রচনার চকিত পরিচয় থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আসলে এগুলো নিছক কাহিনী-কাব্য, যার প্রেরণা বাঙালী কবিগণ পেয়েছিলেন স্কট, বায়রণ প্রভৃতি কবির উচ্ছ্বাসপ্রবণ আখ্যান কাব্যে। জাতীয় জীবনকে সুগঠিত করার চেতনা তাঁদের পেয়ে ব'সেছিল এবং এসব কাব্যে তাঁরা জাতির বলবীর্যের ঐতিহ্যকে রূপ দিতে চেয়েছেন। কাজেই এসব কাব্যের যদি কোন নামকরণ করতে হয়, তা'হলে এদের জাতীয় আখ্যান- কাব্য ব'লে অভিহিত করাই সংগত হবে। অবশ্য বাঙালী চিত্তের গীতি-প্রবণতা, কারুণ্য এবং মাধুর্যপ্রীতি উচ্ছ্বাস এবং আবেগ-প্রবণতা থেকেও এ কাব্যধারা মুক্ত নয়। ক্লাসিক রীতিসম্মত সংযম এবং সংঘবদ্ধতা এমনকি বীর গাথাসুলভ গাম্ভীর্য ও মহিমা এ সব কাব্যে প্রায়শঃই ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বীর হুঙ্কারে কাব্যের সূচনা হ'য়েও চোখের জলে কাব্য হয়েছে প্লাবিত, প্রবল শক্তি সংঘর্ষকে আচ্ছন্ন করেছে নারী-কণ্ঠের কল-কাকলী, যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতাকে ম্লান করে দিয়েছে কৈশোর-প্রণয়ের চাপল্য, আত্মধ্বংসী মহাসংগ্রামের অবসানে জাতির চেয়ে ব্যক্তির দীর্ঘশ্বাসই প্রকটিত হয়েছে বেশী, ধর্ম এবং স্বাধীনতা রক্ষার মরণপণ সংগ্রামকে লঘু ক'রে দিয়েছে তরুন তরুণীর প্রেমলীলা, আদর্শ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার মহাসংঘাতের ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয়েছে নারীর রূপশিখা।
Downloads

Downloads
Published
Issue
Section
License
Copyright (c) 1959 সাহিত্য পত্রিকা - Shahitto Potrika | University of Dhaka

This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivatives 4.0 International License.